নিজস্ব প্রতিবেদক
জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুথান। নতুন বাংলাদেশ গড়ার এক ঐতিহাসিক ঘটনা। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত বছরের ১ জুলাই থেকে। অহিংস এই আন্দোলন সহিংস হয় ১৫ জুলাই থেকে। পরে তা গণ–অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। একসময় দেশ ছেড়ে পালান স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। দেশের মাটিতে উত্তাল ছিল সেই ৩৬ দিন । আর সবশেষ ৫ আগস্ট পতনঘন্টা বাজে স্বৈরাচারি আওয়ামী লীগের। ছাত্র-জনতার এতদিনের আন্দোলনে প্রাণ ঝরে অনেক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের। পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদসহ অনেক জুলাইযোদ্বা। গুরুত্বর আহত হন অনেকে। অনেককেই আবার আওয়ামী পতনের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত থাকতে হয় স্বৈরাচারি হাসিনার পুলিশ বাহিনীর তৈরি আয়নাঘরে বন্দি। সেখানে বসেও অমানুষিক নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে হয় বহু মানুষকে। সেই আয়নাঘর থেকে সহসাই রেহাই মেলেনি বরিশালের যুবক মোঃ সোহাগ হাওলাদারেরও। তিনি নগরীর ২৫ নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সাবেক যুগ্ন আহবায়ক। অপরাধ ছিল ১৯ জুলাই বরিশালে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহীনি দ্বারা মর্মান্তিক আক্রান্তের শিকার নগর বিএনপি’র সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদারকে ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে থাকা ও আন্দোলনে অংশ নেয়া। দীর্ঘ সময়ে প্রতিবেদকের সাথে কথা বলে আয়নারের নির্যাতনের ১০ দিন লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। যদিও সেই নির্যাতনে এখনো তার হাঁটতে বেশ বেগ পোহাতে হয়। এছাড়া কানেও ঠিকভাবে শুনতে পাননা সোহাগ। এছাড়া প্রথম থেকেই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার সাথে একাত্নতা পোষণ ও অংশগ্রহণে আওয়ামী পুলিশ বাহিনীর নজরদারিতে ছিলেন তিনি।
তিনি জানান, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯ জুলাই বরিশাল নগরীর সিএন্ডবি রোডে বিএনপি অবস্থান নেয়। এসময় আওয়ামী লীগের শত শত ক্যাডার বাহিনী দেশী-বিদেশী অস্ত্র নিয়ে বিএনপি’র নেতাকর্মীদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালায়। এসময় আমিও নগর বিএনপি’র সদস্য সচিব মোঃ জিয়াউদ্দিন সিকদারের সাথে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। একপর্যায়ে আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনীর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জিয়া ভাই গুরুত্বর জখম হয়। তার মাথাসহ বিভিন্ন অংশে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে সন্ত্রাসী আওয়ামী বাহীনি। ঐ অবস্থা থেকে জিয়া ভাইকে উদ্বার করে বরিশালের বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরোঘুরি করে কোথাও ভর্তি না নেয়ায় একপর্যায়ে ঢাকায় রওয়ানা দেই। ঢাকাও প্রায় দীর্ঘসময় অনেক হাসপাতালে ছুটোছুটি করেও ভর্তি না নেয়ায় একপর্যায়ে বিএনপি’র স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলামের নিজের একটি হাসপাতাল হেলথ এইড’ এ আশ্রয় ও চিকিৎসা নিতে সক্ষম হই।
সোহাগ আরও জানান, নগর বিএনপি’র সদস্য সচিবের গুরুত্বর এই আক্রান্তের কথা জানতে পারেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান। জিয়া ভাইয়ের মুঠোফোন না থাকায় তিনি তার অবস্থার খোঁজ নিতে আমার ফোনে কল দেন। এ অবস্থায় ঐ সময়ের আওয়ামী ডিবি পুলিশ বাহিনী ফোন নম্বর ট্র্যাক করে আমাকে হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করে। ২৪ জুলাই আমি ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হই। গ্রেপ্তারের পর তারা আমাকে কোন থানায় নিয়ে যায়নি। সরাসরি নিয়ে যায় ডিবি কার্যালয়ে। এরপর সেখান থেকে আমাকে তাদের তৈরি আয়নাঘরে স্থানান্তর করেন ডিবি পুলিশের সদস্যরা। সেখানে আমাকে প্রতিনিয়ত অমানুষিক নির্যাতন চালায় তারা। যার দরুন আমার এখনো হাঁটতে খুব কষ্ট হয়। এছাড়া আমার কানেও কম শুনতে পাই ও ব্যাথা করে। এরপর ২৭ তারিখ কোর্টে নিয়ে আন্দোলনে আহত হওয়ার মেডিকেল সার্টিফিকেট থাকা সত্ত্বেও ৭ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। এরপর কারাগারে না নিয়ে আবারও নেয়া হয় ডিবি কার্যালয়ে। রিমান্ড মঞ্জুর করে এমসি থাকা অবস্থায় সেই আয়নাঘরে পুনরায় রেখে বেধরক আমাকে পেটায় আওয়ামী পুলিশের পেটোয়াবাহীনী।
তিনি বলেন, শুধু আমিই না বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতা রুহুল কবির রেজভী, সালাহউদ্দিন টুকু, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, আন্দালিব রহমান পার্থ, জহিরুল ইসলাম স্বপন, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, আমিনুল হক, ডাঃ হালিম, তারিকুল আলম তেনজিং, ভিপি নুরুল হক নুর, ডাঃ রফিকুল ইসলাম, নিরব, আব্দুস সালাম ভাইসহ অনেক নেতাও ঐস্থানে বন্দি ছিলেন। একপর্যায়ে ৩ আগস্ট আমাকে কোর্টে উঠানো হয়। এর আগে ২ আগস্ট আমার মা ঢাকায় ডিবি কার্যালয়সহ বিভিন্নস্থানে গিয়ে আমার কোন সন্ধান না পেয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি আমার খোঁজ পেতে সহযোগীতা কামনা করেন। প্রশাসন চাপে পড়ে আমাকে ৩ আগস্ট কোর্টে চালান দিলে সেখান থেকে কারাগারে নেয়া হয়। সেখানে আদালত মেডিকেল দেয়ার জন্য বললেও মেডিকেল সার্টিফিকেট থাকা সত্ত্বেও জেলের মধ্যে সাধারণ ওয়ার্ড দেয়া হয়। এরপর ৭ আগস্ট রাত ৩ টার দিকে আমাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। এদিকে সোহাগ জানান, ডিবির আয়নাঘরে থাকাবস্থায় যাত্রাবাড়ি পুলিশ মার্ডারে সংযুক্ত না থেকেও মারধর ও নির্যাতন করে জোরপুর্বক স্বীকারোক্তি নেয়ার অপচেস্টা চালায় পুলিশ।
তিনি আরও জানান, আমার বিরুদ্ধে দুইটি মামলা দায়ের করা হয় । এর মধ্যে একটি হচ্ছে মেট্রোরেল ভাংচুর ও অন্যটি পুলিশ হত্যাকান্ডে জড়িত। অথচ কোনটির সাথেই আমি যুক্ত ছিলাম না। মেট্রোরেল ভাংচুরে ( মামলা নং- ২৯/৩২৭ ) ৯ নম্বর আসামি করা হয়। এছাড়া অন্য মামলার নথি পাইনি।
তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনের আমিও একজন যোদ্বা। তবে এখন পর্যন্ত পাইনি কোন সরকারি সহায়তা। খোঁজ নেয়নি কোন সংস্থাও। যৌক্তিকভাবে আমি জুলাই সনদ প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে। এ বিষয়ে তিনি প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের অন্যান্য সর্বোচ্চ ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সুদৃষ্টি কামনা করেন।